অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে প্রধান বাধা হলো ৩টি। এক. জাতীয় বিভক্তি, দুই. হিংসাত্মক রাজনীতি এবং তিন. কর্মহীন মাদ্রাসা শিক্ষা। এই জাতীয় বিভক্তি ও হিংসাত্মক রাজনীতি কখন, কীভাবে, কেন প্রতিষ্ঠিত হলো, তার শিকড়সন্ধানী অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশকে ঘিরে কোনো একটি দেশের বিশেষ স্বপ্ন ছিল। দেশটি চেয়েছিল বাংলাদেশকে তাদের অনুগত করে রাখতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু তাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলেন। এ কারণে তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরম জিঘাংসু হয়ে পড়ে। সেই জিঘাংসা থেকেই দেশটি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। দেশটি প্রথমে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। এরপর জিঘাংসু দেশটি নিজেদের মতো করে পেতে ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ৬টি ভিশন নিয়ে কাজ করে আসছে। ভিশন ৬টি হলোÑ এক. সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা, দুই. বাংলাদেশে তাদের অনুগত সরকার ক্ষমতাসীন করে রাখা, তিন. বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্য করা, চার. স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা, পাঁচ. বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং ছয়. বাংলাদেশে হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ স্থায়ী করা, যাতে বাংলাদেশ তাদের বিশাল মানবসম্পদ এবং খনিজ সম্পদকে অর্থসম্পদে রূপান্তরিত করতে না পারে, যাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে রাজনীতির নামে হিংসা-বিদ্বেষ আর সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে।এই ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠন করা হয় গণবাহিনী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলÑজাসদ। জাসদ-গণবাহিনীর সশস্ত্র অরাজকতা ও গণহত্যার সঙ্গে ভিশন বাস্তবায়নে যৌথ ও পৃথকভাবে অংশগ্রহণ করে- পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পাটি, পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি, মাওবাদী, চরমপন্থি বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী ছাত্রসংঘ, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনী। এসব দলের সশস্ত্র নেতাকর্মীদের মস্তিষ্কে অতিবিপ্লবের কুমন্ত্রণা প্রথিত করে দেওয়া হয়। প্রথমে এই অতিবিপ্লবীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়। এরপর সেনাবাহিনীর ঘাতকদের ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রদীপ চিরতরে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও আবু হেনা মো. কামারুজ্জামানকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।কর্নেল এম. এ তাহের সেনাবাহিনীর সিপাহিদের নিয়ে গঠন করেন, ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন। তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ব্রিটিশ অথবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো হবে না, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হবে গণবাহিনী। কোনো অফিসার থাকবে না। সেনাবাহিনীর মধ্যে তাহের ও তার গণবাহিনী ‘শ্রেণি সংগ্রাম ও বিপ্লবের’ মন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই মন্ত্র সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ‘স্বর্গপ্রাপ্তি’ ধরনের অনুকূল সাড়া জাগিয়েছিল। তারা কর্নেল তাহেরকে ‘স্বপ্নপূরণের দ্রষ্টা’ হিসেবে বিশ^াস করেছিল। জিঘাংসু দেশটি বঙ্গবন্ধুর খুনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহে অন্ধ করে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লালচেই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল, কিন্তু পরোক্ষভাবে ক্ষমতা জিঘাংসু দেশটির হাতেই ছিল। হত্যাকারীরা ছিল জিঘাংসু দেশটির অনুগত তাদের কোনো জনসমর্থিত রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের জাতীয় নির্বাচনে জনগণ জাসদকে একটিমাত্র আসনে নির্বাচিত করেছিল। তারা জিঘাংসু দেশটির দেওয়া অস্ত্র ও অর্থশক্তিতে বলীয়ান ছিল। ১৫ আগস্ট ছিল জিঘাংসু দেশটির প্রথম ভিশন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের কারণে প্রথম ভিশন ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। এই পাল্টা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবনে ৬ নভেম্বর জাসদ-গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই ভিশন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম) ও সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এ.টি.এম হায়দারকে হত্যা করা হয়। সামরিক আদালতের বিচারে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে ২১ জুলাই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। একই সময়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অসহনীয় দমনপীড়ন করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রাণহীন করে দেওয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়।৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাসদ-গণবাহিনী ঢাকা সেনানিবাসে একটি লিফলেট বিতরণ করে। এই লিফলেটে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল ও কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদাকে ‘ভারতীয় চর’ বলে অপপ্রচার করা হয়। এই লিফলেটের স্লোগান ছিল, ‘সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’। ৭ নভেম্বর রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হয় জাসদের গণবাহিনীর সদস্যরা। তারা প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার লুট করে এবং স্লোগান দেয়, ‘সিপাহি-সিপাহি ভাই-ভাই, সোবেদার-মেজরের উপরে অফিসার নাই’। এই স্লোগান দিয়ে তারা সেনানিবাস আক্রমণ করে। এ সময় গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ঢাকা সেনানিবাস। তারা নির্বিচারে গুলি করে মুক্তিযুদ্ধের দু’জন সেক্টর কমান্ডার, একজন সাব-সেক্টর কমান্ডারসহ ১৩-৩০জন বীরমুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারকে।